এক শরীরচর্চাবিদের আর্কাইভ: ফোটোগ্রাফ, মৌখিক ও দৈহিক ইতিহাস
শরীরচর্চাবিদদের স্মৃতি রক্ষা করার উপায় কি? যাঁরা গান-বাজনা করেন, ছবি আঁকেন বা তোলেন, তাঁদের স্মৃতি কিছু কাজের নমুনার মধ্যে অন্তত রয়ে যায়। যাঁরা নাচেন, তাঁদেরও ছবি বা ভিডিও তোলা থাকতে পারে, কিন্তু যে কোন শিল্পীর শারীরিক যে চর্চা, যে শিক্ষা, তা ধরে রাখা অসম্ভব। ফরাসী দার্শনিক, মরিস মার্ল্যু-পন্টি যেমন বলেছিলেন যে কোন পিয়ানো-বাদকের—বা কোন টাইপিস্টের— দক্ষতার বেশ কিছুটা অংশ লুকিয়ে থাকে তাঁদের আঙুলে। তাঁদের সেই শরীরী দক্ষতা আর্কাইভে যদি সংরক্ষণ করা নাই যায়, তাহলে সেই স্মৃতির কি আর কিছুই বাকি থাকে না? হয়তো এর কিছুটা তাঁরা শিক্ষক হিসেবে দিয়ে যান তাঁদের ছাত্রদের মধ্যে। তাঁরাই হন এই শিক্ষার, এই শারীরিক অনুশীলনের উত্তরাধিকার।
২০১৩ নাগাদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্সট্স অ্যান্ড রেকর্ডস-এর “বাংলার শরীরচর্চা” নামের একটি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে আমার প্রথম আলাপ হয় বিশ্বনাথ দত্তের (১৯২৯-২০২০) সাথে। (প্রজেক্টের অধীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক অভিজিৎ গুপ্ত, এবং গবেষক পদে ছিলেন দীপ্তনীল রায় ও নিখিলেশ ভট্টাচার্য্য।) সেই সময়ে বিশ্বনাথ-দা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কুস্তীগির, যতীন্দ্রচরণ গুহ (১৮৯২-১৯৭২) ওরফে গোবর গোহর একমাত্র ছাত্র, যিনি শেষ বয়স পর্যন্ত নিয়মিত কুস্তিচর্চা ও শিক্ষা চালিয়ে যান। প্রতি শনিবার তাঁকে দেখা যেত গোয়া বাগান স্ট্রীটের আখড়ায়, নিজের মতন করে বহু বছরের সেই ব্যায়ামগুলো অভ্যাস করে, আখড়ার ধুলো গায়ে মেখে, তরুণ শিক্ষার্থীদের কুস্তীর নানান প্যাঁচ কষতে।
কুস্তীর জগতে জাতীয় স্তরে যথেষ্টই নাম করেছিলেন বিশ্বনাথ-দা, অথচ তাঁর সাথে কথা বলতে গেলে আন্দাজ করা যায় যে তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতি জুড়ে রয়েছেন শুধু তাঁর শিক্ষক, গোবর গোহ। নিজের ব্যাপারে বিশেষ কিছুই বলতে চান না শুরুতে। ফিরে যান গোবরের সাথে তাঁর প্রথম আলাপে, বা হয়তো কেমন করে তিনি গোবরের আঙুলের ভাঁজের ইঙ্গিতে পুশ আপ করতে শিখলেন, সেই দিনগুলোয়। সেই দৈহিক শিক্ষা তিনি আজও ধরে রেখেছেন, এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কুস্তীগিরদের ভাগ করে দিতে থাকছেন। আমরা ওরাল ইতিহাস সংগ্রহ করার আশায় ওনার কাছে গিয়েছিলাম—তাই আমাদের জন্য ওনার নানান স্মৃতি ছাড়াও বের করে রেখেছিলেন একটা পুরনো ছবির অ্যালবাম, বেশ কিছু খবরের কাগজের ক্লিপিং, আর কয়েকটা পুরনো পত্রিকা। আখড়ার দুদিকের ঘরগুলোর মধ্যে একটা বড় হলঘর জুড়ে তিনি তৈরি করেছিলেন গোবর গোহ মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা। তাতে এইসব কাগজপত্র ছাড়াও সংরক্ষিত ছিল কিছু গদা, মুগর, ডামবেল ইত্যাদি।
ছবির অ্যালবামটিতে ছিল সেই আখড়ার বহু পুরনো ছবি—এক ধরণের ফটোগ্রাফিক জীবনীও বলা যেতে পারে। একটি ছবিতে আমরা দেখতে পাই আখড়ার প্রবেশ করার দরজা। সময়ের সাথে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি বলে মনে হয়েছিল। গেট-এর ওপর বোর্ডে লেখা গোবরের বাবা, অম্বু চরন গোহর নাম। ১৮৮৭-এ প্রতিষ্ঠিত আখড়াটির পরিচালনায় রয়েছেন গোবর নিজেই - প্রথম ভারতীয় যিনি কুস্তীর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেছেন স্যান ফ্রান্সিসকোতে, ১৯২২ সালে। (রুদ্রনীল সেনগুপ্তের “এন্টার দ্য দঙ্গল” বইটিতে তিনি এই বিষয় কিছুটা আলোকপাত করেছেন।)
আরেকটি ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি গোবর গোহকে, প্রৌঢ় বয়সে। একটি কাঠের বেঞ্চিতে, পাশবালিশে ঠেশ দিয়ে তিনি বসে আছেন, পরনে সাদাসিধা পাজামা পাঞ্জাবী। তাঁর মাথার ওপরে টাঙানো রয়েছে কিছু বিখ্যাত বডি-বিল্ডার আর কুস্তীগিরদের ছবি, এবং তাঁর সাথে গান্ধীরও একটি পোর্ট্রেট। গোবরের এই রূপ যেন তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুরের অবতারের থেকে একেবারেই আলাদা। ১৯২০-র দশকের সেই টুর চলা কালীন তাঁর ওপর একটি লেখা প্রকাশিত হয় রিপ্লির বিলিভ ইট অর নট-এর পাতায়। সেই থেকে জানা যায় তাঁর বিষয়ে নানান “তথ্য”, যেমন গোবর নাকি কাঁচা সোনা খেয়ে শরীরের তেজ বাড়ান। তিনি জর্জ বার্নার্ড শ-এর ভক্ত, কিন্তু চার্লি চ্যাপলিন-কে ততটা পছন্দ করেন না। কুস্তীগির অথচ উচ্চশিক্ষিত বলে তাঁর গুণগান করা হয় এই সব লেখায়।
জোসেফ অল্টার বা রুদ্রনীল সেনগুপ্তের মতন অল্পসংক্ষক ঐতিহাসিক আমাদের দেশের অন্যান্য ঘরানার বা জায়গার কুস্তী শৈলী নিয়ে লিখে থাকলেও, বিগত কিছু বছরে ভারতীয় কুস্তী বা শরীরচর্চার ইতিহাস নিয়ে গবেষণার বেশীরভাগটাই এগিয়েছে বাঙালীর (হিন্দু) কুস্তী কেন্দ্র করে। বিশ্বনাথ-দার সেই অ্যালবামে আমরা খুঁজে পাই কিছু নেগেটিভ প্রিন্ট, যার থেকে আন্দাজ করা যায় যে তাঁরা অবিভক্ত ভারতের নানান জায়গার সুপারস্টারদের খবরাখবর রাখতেন। ছবিগুলো ঐতিহাসিকদের মনে করিয়ে দেয় যে এই ইতিহাসগুলি স্বতন্ত্র ভাবে লেখা অসম্ভব— তাঁর কোথায় যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে রয়েছে আখড়ার ধুলোবালিতে।
আর্কাইভে রয়েছে ছ’টা ছবির একটা গোছা, গ্রিটিংস কার্ড আকারে ছাপা কুস্তীগিরদের পোর্ট্রেট। এর মধ্যে তিনটি অতি সাধারণ ভাবে তোলা ছবি - অনামী তিন জন স্টুডিওতে ক্যামেরার সামনে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটিতে পটভূমি যত্ন করে সাজানো। দেখে মনে হয় কোন নার্সারির ভেতরে তোলা, গাছ-পালা ঘিরে রয়েছে মানুষটিকে। আরও একটি ছবিতে আমরা দেখতে পাই হনুমানের ভঙ্গিতে বসেছেন কুস্তীগির, হাতে গদা। তাঁর আশপাশে সুপার-ইম্পোজ করা হয়েছে তাঁরই আরও কিছু ছবি থেকে কেটে নেওয়া তাঁর মুখ। মনে প্রশ্ন জাগে, এই কার্ডগুলো ছাপার ইতিহাস নিয়ে কি আমরা কিছুই জানতে পারি না?
রহীম পালওয়ান সুলতানিওয়ালা (গুজরনওয়ালা)-র একটি কার্ড এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করে। শোনা যায় যে এই কুস্তীগিরের সাথে নাকি একমাত্র পাল্লা দিতে পারতেন বিশ্ববিখ্যাত গামা পালওয়ান। কার্ডটির ওপরের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি ওঁর পরিচয়, আর নিচে দেওয়া রয়েছে ছাপার স্টুডিওর নাম, ঠিকানা—লাহোরের জালাল-উদ্দিন তসবীর ফিরোশ। “হর কাসাম কি তুর্কি জোয়ানও কি তসবীর কি কার্ড ঔর পেহ্লওয়ানো কি তসবীরে মিল সাকতি হ্যায়,” অর্থাৎ সব রকমের চিত্তাকর্ষক পুরুষদের এবং পালওয়ানদের ছবি এখানে পাওয়া যায়। প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হলেও অনুমান করা যায় যে, ইউজেন স্যান্ডো সমেত আরও অনেক বডি বিল্ডারদের ছবির চাহিদা যেমন সমকামী পুরুষদের মধ্যেই বেশী ছিল, এই সব ফোটোগ্রাফেরও মূল ক্রেতা ছিলেন তাঁরাই।
ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্সট্স অ্যান্ড রেকর্ডস-কে। উর্দু লেখা পড়তে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ বৃন্দা দাশগুপ্ত ও এহতেশাম হাসানকে।